পারস্য উপসাগরে যুদ্ধের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের আলামত সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রহস্যজনকভাবে তেল ট্যাংকার ধ্বংস করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ইরান গুলি করে ভূপাতিত করেছে। সৌদি স্থাপনা এবং বসরা এলাকায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। আমেরিকা পারস্য উপসাগরে একটি নেভাল আরমাডা এবং দুই হাজার ৫০০ অতিরিক্ত সৈন্য প্রেরণ করেছে। ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক চাপ জোরদার এবং সামরিক হামলা চালানোর জন্য আইনগতভাবে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। সর্বশেষ বিশ্বের অত্যন্ত সংবেদনশীল জলসীমা হরমুজ প্রণালী দিয়ে যাওয়ার সময় গত শুক্রবার ব্রিটিশ পতাকাবাহী ট্যাংকার জব্দ করেছে ইরান। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। ট্যাংকারটি অবিলম্বে ছেড়ে না দিলে তেহরানকে ‘ভয়াবহ পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে উপসাগরীয় অঞ্চলে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে।
বিশ্ব ক্রমান্বয়ে মনে হয় একটি ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ইরান যুদ্ধ ও সঙ্ঘাতের মাধ্যমেই সম্ভবত বিশ্ববাসী এই ধ্বংসযজ্ঞের কুৎসিত চিত্র দেখতে পাবে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা বাড়াতে ওয়াশিংটনের সাথে যৌথ পদক্ষেপের অংশ হিসেবে সৌদি আরবে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিয়াদ। সৌদি বাদশাহ সালমান এর অনুমোদন দিয়েছেন। পরমাণু ইস্যুতে ওয়াশিংটন-তেহরান উত্তেজনার মধ্যে শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় টুইটারে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, আসন্ন হুমকি প্রতিহত করতে সৌদি আরবে সামরিক বহর ও সরঞ্জাম মোতায়েন করবে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে ও সৌদি আরবে সেনা মোতায়নের খবর নিশ্চিত করা হয়। খবরে বলা হয়, শিগগির ৫০০ সেনা মোতায়েন করা হবে সৌদি আরবে। ২০১৩ সালে ইরাক আগ্রাসনের সময় সৌদি আরব থেকে মার্কিন সৈন্যদের সরিয়ে ইরাকে মোতায়েন করা হয়। ১৯৯১ সালে ইরাক-কুয়েত আক্রমণ করলে অপারেশন ডেজার্ট স্ট্রম’ অভিযানের সময় প্রথম সৌদি ভূখণ্ডে সেনা পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। এরপর ইরাক যুদ্ধের আগ পর্যন্ত একটানা প্রায় ১২ বছর সেখানে মার্কিন সৈন্যদের জোর উপস্থিতি ছিল। রিয়াদের প্রিন্স সুলতান বিমান ঘাঁটিতে এখনো দুই শতাধিক মার্কিন যুদ্ধবিমান মোতায়েন রয়েছে। পারস্য উপসাগরে ব্রিটেনের ব্যাপক সামরিক উপস্থিতির মধ্যেই একটি ব্রিটিশ তেল ট্যাংকার আটক করেছে ইরান। নিজেদের একটি তেলের ট্যাংকার আটকের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে শুক্রবার ওই ট্যাংকার আটক করে তেহরান।
প্রায় এক মাস আগে জিব্রাল্টার প্রণালীতে চার ক্রুসহ ইরানি ট্যাংকার সেস-১ আটক করে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি। কয়েক দিন পর চার ক্রুর মুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু তেহরানের বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও ট্যাংকার ছাড়তে অস্বীকার করে লন্ডন। এর প্রতিক্রিয়ায় অবশেষে ব্রিটেনের স্টেনাইমপেরো আটকে দেয় তেহরান। ব্রিটেন এ ঘটনাকে সহজভাবে নেয়নি। এ ব্যাপারে জরুরি মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকে ব্রিটেন।
ফ্রান্স, জার্মানি ও ব্রিটেনের ট্যাংকারটি ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট বলেছেন, ভয়ঙ্কর পথে এগোচ্ছে তেহরান। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ধরনের ছোট একটি ভুল থেকেই শুরু হতে পারে মহাযুদ্ধ। এখন থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে ১৯৮৭ সালে ঠিক এভাবেই ইরান-ইরাক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্র-ইরান যুদ্ধ ও সঙ্ঘাত নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ের হতে পারে কিন্তু আবার এ সঙ্ঘাত দ্রুত বিস্তার লাভও করতে পারে। হরমুজ প্রণালীতে তেল ট্যাংকারে হামলার প্রতিশোধ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর গানবোট এবং অন্যান্য নৌ জাহাজের ওপর হামলা চালাতে পারে। অপর দিকে, ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র-যুক্তরাষ্ট্র ও জিসিসি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা করতে পারে। ইরানি অথবা শিয়া মিলিশিয়ারা ইরান, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্যদের ওপর হামলা চালাতে পারে। এ ছাড়াও ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ইসরাইলে আঘাত হানতে পারে। আবার ইসরাইল অধিকৃত এলাকার হিজবুল্লাহ এবং ইরানের মিত্র শক্তি হামলা চালাতে পারে। এ ধরনের হামলা এড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইল, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও নৌ শক্তিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য আগ বাড়িয়ে বড় ধরনের বিমান হামলা চালাতে পারে।
ইরান এবং আমেরিকার পক্ষ থেকে তারা যুদ্ধের ব্যাপারে আগ্রহী নয় বলে দুই দেশের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে বলা হলেও পারস্য উপসাগরে যুদ্ধের সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে ঘটনা কোন দিকে গড়ায়- তা কেউ বলতে পারে না। তবে এটা ঠিক যে, যুদ্ধ কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। আফগান ও ইরাক যুদ্ধের খেসারত এখনো আমেরিকাকে দিতে হচ্ছে। তাই আমেরিকা যে যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চায়- তা সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার তৎপরতা ও আমেরিকার নিষ্ক্রিয়তাই নতুন করে প্রমাণ করেছে। তবে আগামী বছর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেই নির্বাচনে জেতার জন্য ট্রাম্প যুদ্ধ নিয়ে কোন খেলা খেলেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়।